ফসলি জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুকভরা হাহাকার নিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন বাদশা মিয়া (৫৫)। নিজের সন্তানের মতো লালন করা বোরো ধানের ক্ষেত আজ ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঝলসে গেছে। সব স্বপ্ন যেন মুহূর্তেই মাটিতে মিশে গেছে। কীভাবে চলবে সংসার, কীভাবে চলবে জীবনের চাকা—এসব ভাবনায় দিশেহারা এই কৃষক।
ঘটনাটি রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের বামনসর্দার গ্রামের। গ্রামের পাশেই অবস্থিত ‘এমএসবি ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটা।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দূর থেকে জমিগুলোতে পাকা ধান মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা গেলো, ধানগাছের শীষগুলো ঝলসে গেছে। অধিকাংশ ধানই অপরিপক্ব অবস্থায় চিটায় পরিণত হয়েছে। যেসব জমির ধান এখনো শীষ ধরেনি, সেগুলোও বিবর্ণ হয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।

স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, এই ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাদশা মিয়াসহ অন্তত ২৫-৩০ জন কৃষকের ১৫-২০ একর জমির বোরো ধান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ১৫-২০ লাখ টাকা।
কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, ভাটাটিতে কয়লার পরিবর্তে মাঝে মাঝে পুড়ানো হয় পুরোনো জুতা, স্যান্ডেল, এবং প্লাস্টিকের বর্জ্য। এতে নির্গত হয় অতিমাত্রায় বিষাক্ত ধোঁয়া, যা ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বাদশা মিয়া, মদন, সুরেশ চন্দ্র, দ্বীননাথ, নিখিল চন্দ্র, ইউসুফ আলী, রওশন, সিদ্ধার্থ, রঞ্জিত, সুশান্ত ও আবুল কালাম আজাদসহ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বছরের পর বছর আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। ভাটার মালিকের প্রভাবের কারণে কেউ আমাদের কথা শোনে না। কৃষি যদি ধ্বংস হয়, দেশ চলবে কীভাবে?”
তারা আরও জানান, ইটভাটার পক্ষ থেকে মন্টু নামের এক ব্যক্তি নিয়মিত ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, যাতে কৃষকরা কোনো অভিযোগ না করে। তবে মন্টু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে ইটভাটার মালিক মমিনুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, “আমার ভাটার কারণে যদি কৃষকদের ক্ষতি হয়ে থাকে, তাহলে আমি তাদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেব।”
পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, “প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণেই ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি বিশেষজ্ঞ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
রংপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কমল কুমার বর্মন বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হক সুমন জানান, “ইটভাটাটি বন্ধ থাকার কথা ছিল। কীভাবে তা চালু রয়েছে, তা তদন্ত করা হবে। কৃষকরা চাইলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে যেতে পারবেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্তের ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবি, যেন আর কোনো কৃষক এই ধরনের নির্যাতনের শিকার না হয়—এটাই এখন তাদের একমাত্র প্রার্থনা।