সরকারি উচ্চপর্যায়ের তদবির বাণিজ্যের অভিযোগে আলোচনায় উঠে এসেছেন দুই উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি (সাবেক ছাত্র প্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি এবং ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধে কয়েক শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে
অভিযোগ অনুযায়ী, এই তিনজন মিলে গত কয়েক বছরে সরকারি প্রশাসনের ভেতরে একটি তদবির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তারা স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, পানিসম্পদ, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে প্রভাব বিস্তার করে কর্মকর্তাদের বদলি, নিয়োগ ও প্রমোশনের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, মোয়াজ্জেম হোসেন এক সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। কিন্তু উপদেষ্টার এপিএস হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় তার তদবির বাণিজ্য। বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে ঠিকাদারদের হয়ে তদবির করতেন তিনি। বিশেষ করে এলজিইডি, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও সড়ক বিভাগে প্রকৌশলীদের বদলির জন্য মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সন্ধ্যার পর তিনি সেগুনবাগিচার গণপূর্ত অধিদপ্তরে গিয়ে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকৌশলী বদলির তালিকা তৈরি করতেন। প্রতিটি বদলিতে দিতে হতো ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা।
এছাড়া ঠিকাদারদের বিল ছাড় করাতে, পুলিশের অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার ঠিকাদার নিয়োগেও মোয়াজ্জেম সরাসরি তদবির করেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সহকারী তুহিন ফারাবি এবং রাশিয়ায় অবস্থানরত ডা. মাহমুদুল হাসান স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যে সক্রিয় ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, সিভিল সার্জন নিয়োগে প্রতিটি পোস্টের জন্য ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা আদায় করতেন তারা। এমনকি নার্স ও মিডওয়াইফদের বদলিতেও আদায় হতো ২ লাখ টাকা করে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নাম ব্যবহার করে তার মাধ্যমে বহু চিকিৎসক ও কর্মকর্তার বদলি করিয়েছেন এ দুই কর্মকর্তা। সূত্র বলছে, ৮ আগস্টের পর স্বাস্থ্যসচিব বদল হলেও তুহিন-ডা. মাহমুদের তৎপরতা থেমে থাকেনি। তারা সাবেক সচিবের মাধ্যমে আবারও বদলি বাণিজ্যে সক্রিয় হন। হজ টিমে ডাক্তার ও নার্স অন্তর্ভুক্ত করতেও টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “আমি পদত্যাগ করেছি ব্যক্তিগত কারণে। সামনে পিএসসি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাইভা আছে—সে জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি টাকা তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, “আমি এক টাকাও দুর্নীতি করিনি। কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি দায় নেব।”
অন্যদিকে, তদবির বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ সামনে আসার পর স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাবেক সহকারী তুহিন ফারাবিকে ইতোমধ্যেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আর মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ দুজনকে গত ২১ এপ্রিল সরকারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে এই কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানো ডা. মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি আর দেশে ফিরবেন কি না, তা নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ বিরাজ করছে।
এপিএস ও পিওর এই তৎপরতায় সরকারি দপ্তরে তৈরি হয়েছিল এক প্রকার ভয় ও দমননীতির সংস্কৃতি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মোয়াজ্জেম ও তার সহযোগীরা যা চাইতেন—তাদের ভয়ে তা দিতে বাধ্য হতেন কর্মকর্তারা। এমনকি অনেকে নিজের বদলি ঠেকাতেই মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন।