বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় সিগারেট কোম্পানীগুলোর পরিচালিত সিগারেট ব্যবসা অবৈধভাবে ভয়াবহ রূপ নিলেও নিরব ভূমিকা পালন করছে প্রশাসন। সরকার চলতি অর্থবছরে সিগারেটের উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করে স্তর ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করলেও, তা কার্যত কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।
মাঠপর্যায়ে এসব কোম্পানির নিয়োজিত বিক্রেতারা আইন উপেক্ষা করে দোকানদারদের কাছ থেকে সিগারেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে বিক্রি করছে। যার ফলে ভোক্তাদেরকে নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ দিয়ে সিগারেট কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
সরকারি নীতিমতে সিগারেট ৪টি স্তরে বিভক্ত- প্রিমিয়াম স্তর, উচ্চ স্তর, মধ্যম স্তর ও নিম্ন স্তর। চলতি অর্থবছরে সিগারেটের দাম প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি শলাকা ১৬ টাকা, উচ্চ স্তরে ১২ টাকা, মধ্যম স্তরে ৭ টাকা এবং নিম্ন স্তরে ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব দাম প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটের গায়েও স্পষ্টভাবে মুদ্রিত রয়েছে। অথচ বাস্তবে শেরপুরের দোকানগুলোতে বেনসন প্রতি শলাকা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, গোল্ডলিফ ১৫ টাকায়, স্টার ১০ টাকায়, ডারবি ৮ টাকায়, রয়াল ৮ টাকায়, লাকী স্ট্রাইক ১২ টাকায়, নেভী ১০ টাকায়, ক্যামেল ১২ টাকায় ও এলডি ৭ টাকায় এবং শেখ বিক্রি হচ্ছে ৭ টাকায়।
বগুড়া জেলার শেরপুর ও ধুনট উপজেলা এবং শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম ও সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর শেরপুর টেরিটরি গঠিত। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন বেনসন বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজার শলাকা, গোল্ডলিফ ১১ হাজার, স্টার ২১ হাজার, ডারবি ১৮ হাজার, রয়াল ১৫ হাজার এবং লাকী স্ট্রাইক ১২ হাজার শলাকা। অন্যদিকে, জাপান টোবাকো কোম্পানির নেভী বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার, ক্যামেল ৭০০, এলডি ২ হাজার এবং আকিজ টোবাকোর শেখ ৫০০ শলাকা। এই হিসেবে দৈনিক গড়ে বিক্রি হয় ৯৭ হাজার ২০০ শলাকা সিগারেট।
সাধারণ নিয়মে যেকোন পণ্য দোকানদারদের কাছে বিক্রি করা হয় প্যাকেটের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে কম দামে। যাতে দোকানদাররা লাভ সহ বিক্রি করতে পারে। সিগারেটের ক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। কোম্পানি নিজেই খুচরা মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে। ফলে দোকানদারদের কাছে আর লাভের সুযোগ থাকে না এবং বাধ্য হয়ে তারা এর চেয়েও বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে।
প্যাকেটে মূদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ও বাজারমূল্যের ব্যবধানেই প্রতিদিন প্রতিটি শলাকায় অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। শুধু বেনসনের ক্ষেত্রেই ধরা যাক-প্রতি শলাকায় ৪ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করা হলে, দৈনিক ১ হাজার ৫০০ শলাকার বিক্রয়ে অতিরিক্ত আয় দাঁড়ায় ৬০ হাজার টাকা। মাসিক হিসাবে তা ১৮ লক্ষ টাকা। অন্য সব ব্র্যান্ড মিলিয়ে ভোক্তাদেরে পকেট থেকে অতিরিক্ত বেড়িয়ে যায় প্রতি মাসে অন্তত এক কোটি টাকা।
তবে এখানেই শেষ নয়। কোম্পানির সহায়তায় গড়ে উঠেছে একটি চক্র, যারা দোকানদারদের চাহিদার চেয়ে অনেক কম সরবরাহ করে। ফলে ক্ষুদ্র দোকানদারদের বাধ্য হয়ে মজুতদারদের কাছ থেকে বেশি দামে সিগারেট কিনে বিক্রি করতে হয়। এতে করে মুনাফার অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে, আর সাধারণ ক্রেতাকে গুণতে হয় বেশি দাম। ফলে পুরো বাজারে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা ।
শেরপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার বলেন, “আমার দোকানে প্রতিদিন বেনসনের চাহিদা অন্তত ১০ প্যাকেট, অথচ কোম্পানির প্রতিনিধি আমাকে দেয় মাত্র ২ থেকে ৫ প্যাকেট। আমি বাধ্য হয়ে বাইরের বাজার থেকে বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করি।” তিনি অভিযোগ করে বলেন, “প্রতিবাদ করলে সিগারেট সরবরাহ বন্ধের হুমকি দেয় কোম্পানির লোকজন।“
শেরপুর টাউন কলোনী এলাকার সাইদুর রহমান বলেন,”ধুমপান করাকে সামাজিকভাবে অপরাধ মনে করা হয়। তাই আমরা কোন প্রতিবাদ করতে পারি না। আমি প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ শলাকা বেনসন সিগারেট কিনি। এতে দিনে অতিরিক্ত ৬০ টাকা ব্যয় হলেও নিরবে মেনে নেই।“
ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর বগুড়ার ডিলারের শেরপুর টেরিটরির ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম বলেন, “সারাদেশে মতো আমরাও প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে থাকি। কারণ অন্যান্য পণ্যের চেয়ে সিগারেটের বিষয়টি আলাদা।“
তবে কোম্পানীর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে নারাজ জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বগুড়া জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মেহেদী হাসান।
তিনি বলেন, প্যাকেটের গায়ে লেখা মূল্য অনুযায়ি সিগারেট বিক্রি করা কোম্পানীর অপরাধ নয়। বরং খুচরা বিক্রেতারা বেশি দামে বিক্রি করে অপরাধ করছে। এরপরেও কোম্পানীর লোকজনকে খুচরা মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক খান বলেন,”সিগারেট কোম্পানী গুলো প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে ভোক্তা অধিকার আইন লংঘন করছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।“