সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী একটি ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবী জানিয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু করা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। এরপর থেকেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে সংস্কার শুরু হয়েছে । ১৯৭১ সালের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবিধানের পরিবর্তনের পক্ষে রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
মঙ্গলবার (০৩ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধানের সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
এর আগেও বেশকয়েক বার বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য আলোচনা করা হয়। শুধু তাই নয় রাজনৈতিকভাবেই এই প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আমার সোনার বাংলা গানটিকে বাদ দিয়ে অন্য একটি গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে চালু করার। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। আর ক্ষমতায় বসেই খন্দকার মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। আর ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বিভাগের’ অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে। কমিটিকে বলা হয় আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন কোনও একটি গানকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে প্রস্তাব করতে।
রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিক নেতারা বলছেন, দ্বীন মুহাম্মদ এর কমিটি এ বিষয়ে ৩টি বৈঠক করে। সে কমিটি দুটি পছন্দ করে তার মধ্যে একটি গানেক গানের জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গান দুটি হলো, ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ কবিতা। কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আনতে পারেনি দ্বীন মুহাম্মদ এর কমিটি।
১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে আবারও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয় । সে সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়।
সেই সময় জিয়াউর রহমান এর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লেখা গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত রয়েছে। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা এই গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় দেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক। ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা গানটির পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটি’কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান।
প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিপরিষদ টেলিভিশন, বিভাগ রেডিও, এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করেছিলেন।
এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গান গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার পরে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পাথরে চাপা পড়েও যায় সেই নিদের্শনা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ৩য় দফার উদ্যোগ নেয়া হয়।
২০০২ সালের (১৯ মার্চ) বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রীসভার সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ ও শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিকট জমা দেন।
স্বাক্ষরিত ওই সুপারিশপত্রে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে সামনে রেখে জাতীয় সংগীত সংশোধিত করা প্রয়োজন। এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সংস্কৃতি মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি অতি গুরত্বপূর্ণ বলে সচিবের নিকট প্রেরণ করেন।
সচিব জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করেন। এরপর ওই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে সেই সরকারের আমলেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। পরে এই সম্পর্কে আর কোনও তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে দেশের কোনো আইনও নেই। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগীত পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। ২০০৬ সালে নেপালের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়।