বিচিত্রা শিল্পী! পেশাদারিত্বের টানে যারা যাত্রা করে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। নাচ, গান, জাদু ও সার্কাস প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করে এক ব্যস্ত মেলা থেকে অন্য আরেক মেলায়। বিভিন্ন মঞ্চে নাচ গান করে সরাসরি দর্শকদের সামনে। বিচিত্রা শিল্পীদের এই যাত্রা জীবনধারার মতো চলতে থাকে অবিরাম। মেলা এবং উৎসবগুলোতে বিনোদনের প্রধান অংশ হয়ে ওঠে বিচিত্রানুষ্ঠান। যেখানে বিচিত্র ধরনের পরিবেশন শিল্পের সমাবেশ ঘটে।
কিন্তু বর্তমান দৃশ্যপটে সামজিক নিষেধাজ্ঞার মুখে জীবন কাটাচ্ছেন বিচিত্রা শিল্পীরা। সমাজের রক্ষণশীল জাতীগোষ্ঠীদের অশ্লীলতার অভিযোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। এমন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে এই পেশায় জড়িতরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তবে কেউ কেউ অশ্লীলতার অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া সত্তে¡ও নিরুপায় হয়ে এই পেশাতেই রয়ে গেছেন। বিচিত্রা শিল্পীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের হয়ে কাজ করেন।
বিচিত্রা শিল্পী ময়না থাতুনের যাত্রা:
গেল ২৯ মে একান্ত সাক্ষাতকারে কথা হয় এমন এক দলের সদস্য ২৮ বছর বয়সী ময়না খাতুনের সাথে। তিনি পাবনার হান্ডিয়াল উপজেলার বাগল বাড়ি এলাকা থেকে এসেছেন বগুড়ার শেরপুরের কেল্লাপোষী মেলায়। সাক্ষাতকারে ময়না খাতুন চাঁদনী বাজারকে জানান, স্কুল জীবন থেকে নাচগান করতেন। চার বছর যাবৎ তিনি এই পেশায় নিয়োজিত। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত।
ময়না খাতুনের অষ্টম শ্রেণীতে পড়া একটি ছেলে ও একটি ছোটো মেয়ে সন্তান রয়েছে। প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে। পরবর্তীতে বিয়ে করেছেন একজন প্রবাসীকে। ময়না জানান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সকাল ১০ টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত নাচগান করে ২ হাজার টাকা পান। জীবনে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন উল্লাপাড়ার বিদ্যুৎ ক্লাবের মাধ্যমে। তিনি জানান, জীবনে বেশি কিছু আশা নেই। ছেলে মেয়েকে মানুষ করাই তার লক্ষ্য।
সুমি আক্তারের সংগ্রামী জীবন:
আরেক বিচিত্রা শিল্পী ২ সন্তানের জননী ৩০ বছর বয়সী সিরাজগঞ্জের সুমি আক্তার। তারা ৩ ভাই ২ বোন। ছোট বেলায় মা মারা গেছেন। মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তখন থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয় পাশাপাশি নির্যাতন। সুমি আক্তারের ১৪ বছর আগে বিয়ে হলেও তিনি এখন স্বামী পরিত্যক্তা।
স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর বাবার বাড়িতে জায়গা হয়নি। তখন পেট চালাতে দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় গার্মেন্টেসে চাকরি শুরু করেন। খুব কষ্টে জীবন যাপন করতেন, অভাব যেন পিছু ছাড়েনি। এরপর পরিচিত এক মেয়ের মাধ্যমে এই জগতে প্রবেশ করেন সুমি আক্তার, শুরু হয় মেলায় মেলায় নাচ গান।
সুমি বলেন, আমার বড়ো ছেলেটা এখন ১৪ বছরের। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। তাকেও বিভিন্ন জায়গায় আমার জন্য ছোট হতে হয়। তিনি বলেন, যারা টিভির পর্দায় নাচেন তারা সেলিব্রেটি হলেও আমরা মঞ্চে সরাসরি দর্শকদের সামনে পারফর্ম করে সামজিক মর্যাদা হারিয়েছি। সমাজে কেউ মেনে নিতে চায় না। কিন্তু আমি নিরুপায় হয়ে এই পেশায় পড়ে আছি।
রূপালী ও রিয়ার গল্প:
আরেক দলের সদস্য ঢাকার শাহজাহানপুর থানার মালিবাগে জন্মগ্রহন করা ২২ বছর বয়সী রূপালী। এক বছর আগে এই পেশায় এসেছেন। পড়াশোনা করেননি। এখন এই নাচ গান করেই জীবন চালাচ্ছেন। আরেকজন সদস্য বিচিত্রা শিল্পী শেরপুরের রিয়া (১৯)। তিনিও এক বছর আগে এই পেশায় এসেছেন। তার মা মারা গেছেন, বাবা নেশায় আসক্ত। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করা অবস্থায় বিয়ে হয় তার। তার স্বামীও একটি বিচিত্রা দলের সদস্য, বর্তমানে স্বামীর সাথেই বিভিন্ন বিচিত্রানুষ্ঠানে নাচ গান করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের সাথী ও জাদু প্রদর্শনী দলের ম্যানেজার:
ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ২৮ বছর বয়সী সাথী। ১৮ মাস বয়সে মাকে হারিয়ে নানীর কাছে মানুষ হয়েছেন। এরপর তার বিয়ে হয়, দুইটি সন্তান হয়। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী তাকে ছেড়ে যায়। নিরুপায় হয়ে চার বছর যাবৎ এই পেশায় এসেছেন। এমন বিভিন্ন প্রতিকুলতার মাঝেও সাথীর একমাত্র লক্ষ্য সন্তানদের মানুষ করা এবং নিজের পেশায় সান্তনা খুজে পাওয়া।
কথা হয় অহনা জাদু প্রদর্শনী দলের ম্যানেজার আকাশ (৩২) এর সাথে। তিনি জানান, দিনে ১৫ থেকে ২০টি শো চালানো হয়। খুব কম সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে শো গুলো চালানো হয়। তিনি বলেন, জাদু প্রদর্শনীর প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে।
গবেষক এবং সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন:
এ বিষয়ে কথা হয় বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক বাংলা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক প্রফেসর ড. বেলাল হোসেনের সাথে। তিনি বর্তমানে সরকারি মজিবুর রহমান মহিলা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, “যাত্রাপালা বিষয়টি শুরুতে ছিলো হিন্দু ধর্মীয় উপাদানের নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় প্রদর্শন করা। পরবর্তীতে ইংরেজরা আসার পর এখানে সামাজিক উপাদান ঢ়ুকে যায়। ১৮ দশকের দিকে হিন্দুদের দেখাদেখি পীরদের কাহিনী নিয়ে মুসলিমরাও যাত্রাপালা শুরু করে।
এরপরে ১৯ দশকে ইউরোপিয়ানরা এসে আমাদের দেশে ঘরের মধ্যে লাইটিং করে নাটক ব্যবস্থা চালু করে এবং টিকিট কেটে এই নাটক দেখা শুরু হয়। তখন থেকেই জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে এটি সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজনের অংশগ্রহনে বাণিজ্যিকরণের মাধ্যমে যাত্রাপালা আধুনিক শিল্প নামে পরিচিতি পায়। তখন যাত্রাপালাকে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজন হেয় দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। একসময় যাত্রাপালা হয়ে ওঠে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকজনের কালচার।
তিনি বলেন, বর্তমানে মেলায় এবং বিভিন্ন স্থানে যাত্রা শিল্পের নামে চলমান অশ্লীলতার জন্য দায়ী ৩টি পক্ষ, অয়োজক বা মালিক, এক শ্রেণীর দর্শক, পাশাপাশি শিল্পীরাও। এখানে দর্শকের রুচিবোধ অনুযায়ী মালিকরা আয়োজন করছে, তখন শিল্পীরাও বাধ্য হচ্ছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশে বরাবরই শিল্পের চর্চা করেছে পতিতারা। যাদের মধ্যে সৌন্দর্যের পাশাপাশি, নাচ, গান এবং যন্ত্র সংগীতেরও পারদর্শীতা থাকতে হতো।
তিনি মনে করেন, যাত্রা শিল্পকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তবে কিছুটা টিকিয়ে রাখতে সরকারকে শিল্পবান্ধব হতে হবে। জনগনের রুচিবোধের পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষ বিশেষ দিনে নাগরিক পরিবেশে যদি এই আয়োজন করা যায় তাহলে অশ্লীলতার বিষয় থাকবে না। সরকারিভাবে বাছাই করে যাত্রা শিল্পীদের মৌসুমি ভিত্তিক কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠাকিভাবে চর্চা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তখন শিল্পীরাও অশ্লিলতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে”।
বিচিত্রা শিল্পীদের এই বৈচিত্রময় জীবন যাপনের প্রসঙ্গে বগুড়া শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সাহদৎ হোসেন বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যাত্রা প্রদর্শনী দলের মালিকপক্ষ বা আয়োজক কমিটিগুলো চরমভাবে দায়ী। তারা নিজেদের ফায়দা লুটতে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চাকে যেভাবে অপব্যাখ্যা করছে বা করাচ্ছে সেইটা আগে থামানো উচিৎ। পাশাপাশি বিচিত্রা শিল্পীদেরকেও অন্যের প্ররোচনায় অশ্লীল উপস্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ। তাহলেই বাঙালী যাত্রাপালার সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার অপব্যাখ্যা ধীরে ধীরে রোধ করা সম্ভব”।
শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন জিহাদী বলেন, “আমরা লক্ষ্য করি তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন জায়গায় অল্প সময়ের মধ্যে অধিক টাকা ইনকামের জন্য এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী মহল এই ধরনের অশ্লীল প্রদর্শনীর আয়োজনের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতির অপব্যবহার করে। যেখানে শিল্পীরাও টাকার জন্য এই ধরনের অশ্লীল প্রদর্শনে রাজি হচ্ছে। তবে আমরা যদি সরকারি ও বেসরকারি ভাবে বাংলা সংস্কৃতির সঠিক চর্চার মাধ্যমে এই শিল্পীদের পেশাগত স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে পারি এবং সকল শিল্পীদরে সংমিশ্রণে দর্শকদের গুনগত শিল্প উপহার দিতে পারি, তাহলে আবারো বাংলা সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ ফিরে আসবে বলে মনে করি”।