সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। তবে তার ওই পোস্টের কিছু অংশের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে আজ রোববার ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দিয়েছেন এনসিপির আরেক সংগঠক সারজিস আলম।
সারজিস আলম তার পোস্টে লিখেছেন, ‘সেদিন (১১ মার্চ) সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি। বরং এর ফলে পরবর্তীতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সাথে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে।’
এর আগে, সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ এক প্রতিবেদনে সেনা সদর দপ্তরকে উদ্ধৃত করে বলেছে, হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্ট ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্টান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়’।
এর আগে, গত শুক্রবার (২২ মার্চ) এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, গত ‘১১ই মার্চ, সময় দুপুর আড়াইটা।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমি (হাসনাত) আপনাদের বলেছিলাম যে “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
এই পোস্ট প্রকাশের পর রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় সারজিস আলম তার ব্যাখ্যা দিয়ে একটি পোস্ট দেন। তিনি বলেন, ‘১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ নিয়ে আমার জায়গা থেকে কিছু সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন: সেদিন আমি এবং হাসনাত সেনাপ্রধানের সাথে গিয়ে কথা বলি। আমাদের দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি যেতে পারেননি।
প্রথমেই স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখি (সারজিস), সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারের সাথে যখন প্রয়োজন হতো, তখন মেসেজের মাধ্যমে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ও উত্তর আদান-প্রদান হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেদিন সেনাপ্রধান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে অনেকটা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিলেন এবং বললেন, “এনাফ ইজ এনাফ,” তখন আমি সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারকে জিজ্ঞাসা করি—আপনারা কি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখছেন? সেনাপ্রধানের বক্তব্য তুলনামূলকভাবে স্ট্রেইট-ফরোয়ার্ড এবং হার্শ মনে হচ্ছে। তিনি আমাকে বললেন, “তোমরা কি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাও?” আমি বললাম, “বলা যেতে পারে।” এরপর আমাদের সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে আমরা তিনজনই ছিলাম—সেনাপ্রধান, হাসনাত এবং আমি।’
‘মানুষ হিসেবে যেকোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে, আমার সেক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে। আমার দৃষ্টিতে, সেদিনের বক্তব্য সরাসরি “প্রস্তাব” দেওয়ার আঙ্গিকে ছিল না বরং “সরাসরি অভিমত প্রকাশের” মতো ছিল।’
সারজিস আলমের ব্যাখ্যায় উঠে আসে আরও কিছু বিষয়। তিনি বলেন, ‘“রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের” জন্য “চাপ দেওয়া হয়েছে” এমনটি আমার মনে হয়নি। বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, সেই বিষয়টি সেনাপ্রধান আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্যাখ্যা করেছিলেন।’
হাসনাত আবদুল্লাহ তার পোস্টে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আলোচনার এক পর্যায়ে আমি বলি—যেই দল এখনো ক্ষমা চায়নি, অপরাধ স্বীকার করেনি, সেই দলকে আপনারা কিভাবে ক্ষমা করে দেবেন?’
এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান রেগে গিয়ে উত্তর দেন, “ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম এন্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি।”
এই প্রসঙ্গে সারজিস আলম বলেন, ‘এই কথোপকথন সত্যি, তবে এটি মূল রুমের আলোচনা শেষে, বাইরে গাড়িতে ওঠার আগে বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। সেনাপ্রধান রেগে গিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়নি, বরং তিনি সিনিয়র হিসেবে অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন।’
সারজিস আলম তার পোস্টে স্পষ্ট করেন, ‘আমি “হাসনাত না ওয়াকার” এই ন্যারেটিভ এবং স্লোগানকে প্রত্যাশা করি না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে মুখোমুখি দাঁড় করানোও কখনো প্রাসঙ্গিক নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেনাপ্রধানের পদত্যাগ নিয়ে যেসব কথা ছড়ানো হচ্ছে, সেটি আমাদের বক্তব্য নয়।’
সারজিস আলম তার পোস্টে আরও বলেন, ‘দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগাযোগ থাকেই। সেই গোপনীয়তা তারা বজায় রাখে। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই হওয়া উচিত ছিল। হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে দলের অভ্যন্তরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।’
তিনি মনে করেন, ‘যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে এসেছে, তা সমীচীন হয়নি। এর ফলে ভবিষ্যতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে।’
পোস্টের শেষে সারজিস আলম উল্লেখ করেন, ‘আমার বক্তব্যে হাসনাতের বক্তব্যের সাথে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত রয়েছে। তবে আমি মনে করি, আত্মসমালোচনার মানসিকতাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যাবে। আমরা হাসিনা রেজিমের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও লড়াই অব্যাহত থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো আওয়ামী লীগের যেকোনো ভার্সনের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।’