বগুড়ার শেরপুরে জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল রেজিস্ট্রির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দলিল লেখক সমিতিকে ম্যানেজ করে ভুয়া নামজারি, ভুয়া ডিসিআর, ভুয়া খাজনার রসিদ ও ভুয়া ওয়ারিশন সার্টিফিকেট দিয়ে দলিল নিবন্ধন করা হচ্ছে। দলিল লেখক ও সাবরেজিস্ট্রারের যোগসাজশে সম্পন্ন হচ্ছে এসব দলিল রেজিস্ট্রেশন। এখানে টাকা দিলে যেমন জাল দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব, ঠিক তেমনই দাবিকৃত টাকা না দিলে দলিল রেজিস্ট্রি করা অসম্ভব।
এছাড়াও রয়েছে দলিলের নকল কপি তোলা, দানপত্র, বন্টনপত্র, ঘোষণাপত্র, অংশনামা ও চুক্তি পত্রের মতো দলিল রেজিস্ট্রিতেও সেবাগ্রহিতাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত টাকার কয়েক গুন বেশি নেওয়ার অভিযোগ। বাধ্য হয়েই ক্রেতা বিক্রেতারা দাবিকৃত টাকা দিয়েই জমি রেজিস্ট্রেশন করছেন। এভাবে জিম্মি করে ক্রেতা বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবৎ এভাবেই অনিয়ম দুর্নীতি ও জালিয়াতি চলছে শেরপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে।
দলিল লেখক সমিতি ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়না। আবার সাহস করে কেউ মুখ খুললেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সকলকে ম্যানেজ করেই নিজেদের কাজ সম্পন্ন করছেন সেবাগ্রহীতারা।
সম্প্রতি দলিল লেখক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পিওনের বিরুদ্ধে হয়রানী ও চাঁদা দাবীর অভিযোগ করেন শেরপুর পৌর শহরে বাসরত নাজনীন পাভীন পলি নামের এক ভুক্তভোগী নারী । গেল ৬ মার্চ একই ঘটনায় ‘শেরপুর উপজেলা প্রেসক্লাব’ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এবং পরেরদিন ৭ মার্চ শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, গত ৪ মার্চ আমার ২ শতাংশ জমি বিক্রি করতে গেলে দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন সমিতির জন্য ১ লক্ষ টাকা ও অফিস সহায়ক জাহিদুল ইসলাম সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য ২০ হাজার টাকা দাবী করেন।
দাবীকৃত টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় জমির রেজিস্ট্রি করতে পারিনি। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ করেছি কিন্তু এখনও প্রতিকার পাইনি। সাব-রেজিস্ট্রার তার কাগজ পত্রের সঠিকতা নিশ্চিত করার পরেও দলিল লেখক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অফিস সহায়কের দাবীকৃত অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় তার দলিল আটকে রাখা হয়েছে। যদিও টাকা দাবীর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা।
জাল খাজনার রসিদ ব্যবহার:
এর পরেই অনুসন্ধানে মেলে খাজনার রসিদ জাল করে জমি নিবন্ধনের তথ্য। দলিল রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে খাজনা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও দলিলের তথ্য অুনুযায়ী, গেল ২৭ ফেব্রুয়ারী খামারকান্দি ইউনিয়নের ঘোরদৌর মৌজার ৪১৩ নম্বর খতিয়ানের দলিল (নম্বর ১৩০২), জাল খাজনার রসিদ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। যার খারিজের আবেদন এসিলেন্ড অফিসে প্রক্রিয়াধীন (কেস নম্বর ৫৩৬৫ ও ৫৩৭২) রয়েছে, কিন্তু বগুড়ার শেরপুরে জালিয়াতির মাধ্যমে ভূয়া খাজনা খারিজের কাগজ সৃষ্টি করে দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে।
দলিল রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত খাজনার রসিদটি জাল নিশ্চত করে খামারকান্দি ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা শামীমুজ্জামান বলেন, “আমাদের সার্ভারের তথ্য অনুযায়ী উল্লেখিত খতিয়ানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাছাড়া খাজনা পরিশোধের রসিদে ব্যবহৃত কিউআর কোড স্ক্যান করেও কোনো তথ্য না পাওয়ায় নিশ্চিত করে বলা যায় রশিদটি জাল”।
তথ্য অনুযায়ী এই ধরনের জাল কাগজপত্র হরহামেশাই তৈরী করে দেওয়া হয় সাবরেজিস্ট্রি অফিসের আশে পাশে গড়ে ওঠা ফটোষ্ট্যাট ও কম্পিউটার কম্পোজের দোকান গুলোতে।
জাল ওয়ারিশান সার্টিফিকেট:
এছাড়াও জাল ওয়ারিশান সার্টিফিকেট তৈরী করেও বেআইনিভাবে একজনের জমি অন্য জনের নামে রেজিস্ট্রি করা হয় এই অফিসে। এমন এক ঘটনার ভুক্তভোগী উপজেলার বিশালপুর ইউনিয়নের নাইয়ের পাড়া গ্রামের ৭৬ বছর বয়সী অমূল্য চন্দ্র সরকার। তার মৃত পিতাকে নিঃসন্তান দেখিয়ে তার কাকাতো ভাই নির্মল চন্দ্র সরকার একটি জাল ওয়ারিশান সর্টিফিকেট তৈরী করেন। এরপর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর সকল জমি তার ২ ছেলে মনোরঞ্জন চন্দ্র সরকার ও সুভাস চন্দ্র সরকারের নামে লিখে দেন।
একই জাল ওয়ারিশান সার্টিফিকেট দিয়ে যখন জমিগুলো নামজারির আবেদন করা হয়। তখন তদন্ত করে জালিয়াতি ধরা পড়লে বিশালপুর ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম নামজারির আবেদন না মঞ্জুর করার জন্য প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই জালিয়াতির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বিশালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।
এছাড়াও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একটি ১০ পাতার দলিলের জন্য নির্ধারিত স্ট্যাম্পসহ গ্রাহকের খরচ হওয়ার কথা ৭২০ টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দলিল লেখক সমিতির হস্তক্ষেপে প্রতি দলিলে সর্বনিম্ন ২৬ শো থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। এখানে দলিল লেখক সমিতির মাধ্যম ছাড়া সাবরেজিস্ট্রার কর্তৃক সিল সিগ্নেচারকৃত সার্টিফায়েড দলিলের কপি পাওয়া সম্ভব না। ২টি দলিলের নকল তুলতে ৬ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন, পৌর শহরের ভুক্তভোগী বিশ্বনাথ চন্দ্র দাস। গত মার্চ মাসের ২ তারিখে তিনি দলিলেন নকল তুলেছেন।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য অনুযায়ী একটি বিক্রয় দলিলের জন্য লিখিত মোট মূল্যের রেজিস্ট্রেশন ফি ১%, স্ট্যাম্প শুল্ক ১.৫%, উৎসে আয়কর ৪%, স্থানীয় সরকার কর পৌরসভার জন্য ৩% ও ইউনিয়নের জন্য ২% এবং দশ পাতার একটি দলিলের জন্য হলফ নামা ৩০০ টাকা, ই ফিস ১০০ টাকা, এন ফিস ২৪০ টাকা, এনএন ফিস ৩৬০ টাকা, কোর্ট ফি ১০ টাকা লাগার কথা।
অর্থাৎ পৌর শহরে ১ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি দলিল নিবন্ধন করতে সরকারি খরচ ১০ হাজার ৫১০ টাকা এবং ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ৮ হাজার ৫১০ টাকা। সেখানে দলিল লেখক সমিতির মাধ্যমে পৌরসভার জন্য প্রতিলাখে ১৩ হাজার ও ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ১১ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
বগুড়ার শেরপুরে জালিয়াতির বিষয়গুলো স্বীকার করে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন দলিল লেখক জানান, এখানে প্রতি দলীলের জন্য সমিতিতে লাখে ১ হাজার দিতে হয়। হেবার ঘোষনা, বন্টন, অছিয়ত দলিলে ১ থেকে ৫ শতক পর্যন্ত দিতে হচ্ছে ১ হাজার, ৫ থেকে সাড়ে ১৬ শতক পর্যন্ত ২ হাজার, সাড়ে ১৬ থেকে ৩৩ শতক পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার এবং ৩৩ এর পরে প্রতি বিঘায় ২ হাজার টাকা।
এরপর অফিসে নেওয়া হলে অফিস স্টাফের মাধ্যমে দলিল মূল্যের প্রতি লাখে ৩০০ টাকা, ডিআর ফি ৭০০ টাকা এবং বিক্রেতার টিপসই ও দলিলের রশিদের জন্য নেওয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা।
দলিল লেখক জানান, সমিতির মোট সদস্য ১৯৬ জন, এর মধ্যে নেতা ৩২ জন। এখানে যেকোনো দলিল লিখে প্রথমে সমিতির ঘরে নিতে হয়। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করলে পাওয়া যায় যে কোনো একজন নেতার সাক্ষর। এরপর দলিল সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে নিতে হয়। এর ব্যত্যয় হলে সমিতির সেই সদস্যকে সাসপেন্ড করে রাখা হয়। এখানে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস করেন, সপ্তাহে রবি, সোম ও মঙ্গল। আর সমিতির আদায়কৃত টাকা প্রতি মঙ্গলবার বিভিন্ন হারে সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হয়।
তবে অনিয়ম-দুর্নীতির এসব বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিতে রাজী হননি শেরপুর সাব-রেজিস্ট্রার মো: মিজানুর রহমান। কথা বলার জন্য তার অফিসে একাধিক দিন গেলেও বিভিন্ন অযুহাতে কথা বলেননি তিনি।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা রেজিস্ট্রার মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে অফিস চত্ত্বরে দলিল লেখক সমিতির ঘরের কোনো অনুমোদন নেই।