কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর পেশা। একসময় হাট-বাজারে পিঁড়ি বা টুলে বসে চুল-দাড়ি কাটার যে চিরায়ত দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়তো, তা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আধুনিক সেলুন ও পার্লারের চাকচিক্যের ভিড়ে এই পেশার কারিগররা এখন অস্তিত্ব সংকটে।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের উপস্থিতি এখন নগণ্য। উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বারদুয়ারী হাটেও এখন কালেভদ্রে দু-একজন নরসুন্দরের দেখা মেলে, যারা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও পৈতৃক পেশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন।
মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চুল-দাড়ির ভূমিকা অনেক। আর এই সৌন্দর্যবর্ধনের নিপুণ কারিগর হলেন নরসুন্দরেরা, তবে তারা স্থানীয়ভাবে ‘নাপিত’ হিসেবেও পরিচিত। আশি ও নব্বইয়ের দশকে গ্রামগঞ্জ এমনকি শহরের অলিগলিতেও দেখা মিলত এসব ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের। তাদের সম্বল ছিল একটি কাঠের বাক্স, যাতে থাকত ক্ষুর, কাঁচি, পিতলের চিরুনি, সাবান, ফিটকিরি ও পাউডার। গ্রাহককে জলচৌকি বা পিঁড়িতে বসিয়ে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে নিপুণ হাতে তারা চুল-দাড়ি কাটতেন।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মানুষের রুচি ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। এখন শহর থেকে গ্রাম, সবখানেই গড়ে উঠেছে আধুনিক জেন্টস পার্লার বা সেলুন। বাহারি সব স্টাইল ও আধুনিক সরঞ্জামের ভিড়ে হাটবাজারের সেই খোলা আকাশের নিচে চুল কাটার দৃশ্য এখন নতুন প্রজন্মের কাছে গল্পের মতো মনে হয়।
বংশপরম্পরায় এই পেশায় টিকে থাকা কারিগরদের জীবন এখন আর আগের মতো সহজ নেই। শেরপুর উপজেলার রানীরহাট বাজারের নরসুন্দর মনমতো শীল জানান, তিনি দীর্ঘ ৪০-৪৫ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। বর্তমানে সপ্তাহে দুই দিন হাটে ভ্রাম্যমাণভাবে কাজ করেন।
অতীত ও বর্তমানের আয়ের তুলনা করে তিনি বলেন, “১৫-২০ বছর আগে চুল-দাড়ি কাটার মজুরি ছিল ৪-৫ টাকা, তাতেই সংসার ভালোভাবে চলত। এখন চুল কাটার রেট ২৫-৩০ টাকা। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সারাদিন কাজ করে ২০০-৩০০ টাকার বেশি আয় হয় না। এই সামান্য আয়ে সংসার চালানো এখন খুবই কষ্টকর।”
আধুনিক সেলুনের ভিড়েও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এখনো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের সেবা নিচ্ছেন। চুল কাটাতে আসা আব্দুল শেখ ও রতন জানান, আধুনিক সেলুনে চুল কাটার খরচ অনেক বেশি। তাই সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা পেতে তারা দীর্ঘদিন ধরে এই ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের কাছেই চুল কাটাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আধুনিকতার দাপটে এবং নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহের কারণে গ্রামবাংলার এই লোকজ পেশাটি হয়তো অচিরেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে।


